মাইক্রোগ্রিন আসলে কি?
ফেসবুকে প্রায়ই একটা অ্যাড দেখতাম মাইক্রোগ্রিন্স নিয়ে। এমিনিতেই আমি অরগানিক খাবার খুজে বেড়াই। আর সুপার ফুড তাও আবার অরগানিক সুপারফুড হলে তো কথাই নেই। যা হোক আমি সেই মাইক্রোগ্রিন্স এর প্যাকেজ টি কিনে ফেলি। পরাশোনা শুরু করে দেই মাইক্রোগ্রিন্স্স নিয়ে। নিজে গাছ লাগালাম। আলহামদুলিল্লাহ্ প্রথম বারেই সফল। বেশ উতসাহ ও দিতে লাগলো সবাই। আজকে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব মাইক্রোগ্রিন্স কি? কিভাবে গাছ লাগাতে হয়? খরচ কেমন হয়? সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি। তো চলুন শুরু করা যাক।
মাইক্রোগ্রিন
কৃষি প্রযুক্তির একটি চমৎকার উদ্ভাবণ হচ্ছে এই মাইক্রোগ্রিন্স। চাষবাস এর ধারণা কে পালটে দিচ্ছে। শহরের বাড়ি তে ঘরে বসে স্মার্ট ভাবে। চাষ করা যায় এই মাইক্রোগ্রিন্স। এ যেন এক স্মার্ট কৃষি। দেখতে খুব ই সাধারণ কিন্তু এর মাধ্যমেই শহরের চাষীরা পূরণ করে নিতে পারেন তাদের পরিবারের প্রতিদিনকার পুষ্টিগুণের চাহিদা। মাইক্রোগ্রিন্স চাষের জন্য সরাসরি সূর্যের আলোর ও দরকার হয় না । বারান্দা কিংবা জানালার পাশের আলো ই যথেষ্ট।
১৯৮০ এর দশকে ক্যলিফোরনিয়ার শেফ রা মাইক্রোগ্রিন্স ব্যবহার করত খাবারের মেইন ডিশ এর সাথে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য। পরবর্তীতে এটির পুষ্টিগুণ উপলব্ধ করা হয়। মাইক্রো মানে আমরা সবাই জানি যে ছোট কিংবা অনেক ছোট আর গ্রিন মানে সবুজ। তাহলে সবুজ ছোট গাছ গুল ই হচ্ছে মাইক্রোগ্রিন্স্স। এটা মূলত বিশেষ এক প্রকার ট্রে এর মধ্যে করা হয়। ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই গাছ গুল খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠে। মাইক্রোগ্রিন কিন্তু ভরপেট খাওয়ার প্রয়োজন পরে না বরং পুস্টিগুণ টাই এখানে মুখ্য। সাধারণ সবজি থেকে মাইক্রোগ্রিন্সে অধিক পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়। মাইক্রোগ্রিন্স এর স্বাদ ও অনন্য। একেক বীজের মাইক্রোগ্রিন এর স্বাদ একেক রকম। রেডিস বা মুলার মাইক্রোগ্রিন্স এক রকমের স্বাদ অন্য দিকে মাস্টারড বা সরিষা এর মাইক্রো গ্রিনে ভিন্য রকমের স্বাদ।
সংক্ষেপে মাইক্রোগ্রিন চাষ পদ্ধতি
যে সমস্ত শাক সবজি একেবারে চারা অবস্থায় খাওয়া যায় সেগুলার ই মাইক্রোগ্রিন্স্স হয়। বাদ বাকি সবজির কিন্তু মাইক্রোগ্রিন্স করা হয় না। সাধারণত রেডিস বা মূলা, মাস্টারড বা সরিষা, পালং, কলমি, গম, লাল শাক ইত্যাদি এর মাইক্রোগ্রিন্স করা হয়।
চাষ করার জন্য আপনার প্রয়জোন হবে বিশেষ ধরণের ট্রে (আসলে ২ রকমের ২ টি ট্রে), কোকো পিট (সাধারণত ছোট আকারের বীজের জন্য লাগে) এবং পানি।
- প্রথমেই কোকপিট গুলা ২ /১ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে যেমন এটা পানির শোষণ করে নিবে তেমনি পরিস্কার ও হয়ে যাবে।
- এবার ভেজানো কোকো পিট থেকে অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নিতে হবে।
- তারপরে কোকপিট গুলা ছিদ্রযুক্ত বিশেষ ট্রে তে ঢেলে দিতে হবে। এমন ভাবে বসাতে হবে যেন পুর ট্রে জুড়ে কোকোপিট গুলা ছড়ানো থাকে।
- এবার বীজ গুলা বপনের পালা। খেয়াল রাখতে হবে যে বড় বীজ গুলা কিন্তু আগে থেকেই.৬/৭ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া উত্তম। যেমন গমের বীজ। তবে ছোট বীজ যেমন সরিষা বীজ আগে থেকে ভেজানোর দরকার নেই।
- এবারে বীজ গুল এমন ভাবে কোকোপিট বিছানো ট্রে এর উপরে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন একটার উপরে আরেকটা না বসে বরং সুন্দরভাবে সাজানো হয়।
- এবারে আরেকটি ট্রে (যেটা ছিদ্রযুক্ত নয়) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ঢাকের পরে উপরে কিছু দিয়ে চাপ দিয়ে রাখলে ভাল হয়। তারপর অন্ধকার কোন শুস্ক যায়গায় রেখে দিতে হবে।
- প্রতিদন একবার করে পানি স্প্রে করে দিতে হবে।
- ২ দিন পরে বীজের অংকুর উদ্গম হয়ে গেলে ট্রে টা উল্টো করে ঢেকে দিয়ে আবার আগের মত অন্ধকারে রেখে দিতে হবে।
- ৩য় দিনের দিন নিরেট ট্রে টি নিচে দিয়ে দিতে হবে। ততদিনে ছদ্রযুক্ত ট্রে এর নীচ দিয়ে শিকড় বেরুবে। ণিচের ট্রে তে এমন ভাবে পানি দিয়ে রাখতে হবে যেন শিকড়ে পানি পৌছায়। এবারে আর অন্ধকারে নয় বরং আলোতে দেখে দিতে হবে।
- এভাবে ৬/৭ দিন পরে দেখা যাবে মাইক্রোগ্রিন্স্স গুলো হারভেস্ট করার জন্য রেডি হয়ে গেছে।
উপকারিতা
- এতে আছে ভিটামিন বি, কে, সি, ই ইত্যাদি
- অনেক খনিজ উপাদাম বিদ্যমান যেমন আয়রন, জিঙ্ক, পটাসিয়াম, ম্যাগ্নেসিয়াম এবং কপার।
- এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এবং ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ।
- মানবদেহের ওজন কমাতে সয়াহতা করে।
- স্কিন হেলথ এর উন্নতি করে।
- হজমে সয়াহক।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
অপকারিতা:
- মাইক্রোগ্রিন্স এর শেল্ফ লাইফ অনেক কম এবং এটি সংরক্ষন করে রাখলে এর পুষ্টিগুণ কমতে থাকে।
- মাইক্রোগ্রিন্সের উৎপাদন খরচ তুলনামুলক ভাবে বেশি।
- অনেকেই ভাবতে পারেন যে মাইক্রোগ্রিন্স তো খাচ্ছি তাই যথেষ্ট পুষ্টি পাচ্ছি আর তাই অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কম খেতে পারেন। আর এভাবে শরীরের পুস্টির চাহিদা পূরণ নাও হতে পারে।
- মাইক্রোগ্রিন্স একবার কেটে নেয়ার পরে গোড়া থেকে আর উৎপন্ন হয় না।
মাইক্রোগ্রিন সংরক্ষণ
প্রথমেই শুকিয়ে নিতে হবে, তারপরে সেগুলিকে টিস্যু পেপারের ভিতরে পেচিয়ে রাখতে হবে। টিস্যু পেপার টি স্যাঁতসেঁতে করে রাখতে হবে। তারপর এগুলা কে প্ল্যাস্টিকের পাত্রে রাখা যেতে পারে। তারপর রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করুন। সরাসরি আলো থেকে দূরে রাখা ভাল। প্রতিদিন পানি স্প্রে করা ভাল, তবে খুব বেশি পানি দিলে নস্ট হয়ে যেতে পারে।
কিভাবে খাওয়া যায়
মাইক্রোগ্রিন্স বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। ইয়তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নমুনা আলোচনা করা হল
- সালাদ হিসেবে খেতে পারবেন।
- স্যান্ডউইচ এর মাঝে দিয়ে খেতে পারবেন
- বারগার এর মাঝে দিয়ে খেতে পারবেন
- শুধু কাঁচা ও খাওয়া যায়
- ঝালমুড়ি তে দিয়ে খেতে পারবেন
মাইক্রোগ্রিন কি প্রতিদিন খাওয়া যাবে?
সোজাকথায় বললে ব্যালেন্স ডায়েটের অংশ হিসেবে প্রতিদিন ই খাওয়া যাবে। তবে শুধুমাত্র মাইক্রোগ্রিন্স খেলেই চলবে না। অন্যান্য পুষ্টিকর শাক সবজি অ খেতে হবে পাশা পাশি। সাধারণ ভাবে প্রতিদিন ১ কাপ মাইক্রোগিন্স খাওয়া যেতে পারে। তবে একজন পুষ্টিবিদ এর পরামর্শ গ্রহণ করে খাওয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করলে ভাল কারন তিনি আপনার শরীরের কন্ডিশন অনুযায়ী সাজেস্ট করতে পারবেন।
মাইক্রগ্রিন্স কি সবজি প্রতিস্থাপন করতে পারে?
আসলে ব্যালেন্স ডায়েট অনুসরণ করলে বুঝা যাবে প্রতিদিন আমাদের শরীরে কি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। তার একটা অংশ এই মাইক্রো গ্রিন্স থেকে পাওয়া যাবে। তাই বলে শুধু মাত্র মাইক্রো গ্রিন্স এর উপর একান্ত ভাবে নির্ভর করলে চলবে না। পাশাপাশি সাধারণ শাক সবজি ফল মূল খেতে হবে। তবে হ্যাঁ মাইক্রোগ্রিন্স নিজের হাতে লাগানো, কোনরকমের কীটনাশক বা ক্যামিকেল দেয়া হয় না তাই এটা খেলে এক শরনের মানসিক শান্তি ও লাগে।
খরচের ধারণা
আপনি যদি বারজার থেকে রেডিমেড কোন সেটাপ কিনতে চান তাহলে ১০০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে বীজ সহ। কিন্তু যদি মনে করেন নিজে নিজে করবেন তাহলে সেটাও করতে পারেন। শুধু বীজ টা কিনলেই চলবে। তবে শহরের মানুষ এত ঝামেলা নিতে চায় না। অত সময় কোথায়? তাই অনেকেই রেডিমেড সেটাপ টাই কিনে নিতে পছন্দ করবেন।
শেষ কথা
আসলে যে যুগ এসেছে ভেজালের ভীরে আসল জিনিস খুজে পাওয়া বেশ মুশকিল। কীটনাশক, ফরমালিন আরো কি কি হাবিজাবি ক্যামিকেল এর কারনে টাটকা শাক সবজি তো পাওয়াই যাচ্ছে না অন্যাদিকে স্বাস্থ্যঝুকি তো বেড়েই চলেছে। ঘরে বসে মাইক্রোগ্রিনের চাষ হতে পারে এর একটি ভাল বিকল্প। একদিকে যেমন গারডেনিং করার সখ ও মিটে যায় অন্যদিকে পুষ্টির চাহিদা ও পুরণ হয়ে যায়। তাই আসুন সবাই মিলে মাইক্রোগ্রিন চাষ করি। নিজের ফসল নিজেই ফলাই। ভেজাল মুক্ত সবজি ও পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করি।
তথ্যসুত্রঃ
এই লেখাটি লিখতে ‘হেলথলাইন’ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে